জাতীয় ঐক্য ব্যতীত স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষিত না, ডঃসুফি সামস্ সাগর,

- আপডেট সময় : ১২:৪৪:৫৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ মার্চ ২০২৩ ৯১ বার পড়া হয়েছে

জাতীয়ভাবে দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ব্যতীত রাষ্ট্রের শান্তি, সমৃদ্ধি, সংহতি, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষিত হয় না। যে রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর কৃষ্টির বন্ধন যত মজবুত, সেই রাষ্ট্রের জাতীয় ঐক্য ও রাষ্ট্রীয় সংহতি তত সুকঠিন। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হলে তাদের কৃষ্টির বন্ধন মজবুত করতে হয়। কৃষ্টির বন্ধন বিভেদ রেখাকে মুছে দেয়। এ জন্যই বাঙ্গলার উৎস ও ইতিহাস জানা দরকার। বাঙ্গলার ইতিহাস বিগত হাজার হাজার বছরের। ‘বঙ্গ’ থেকেই ‘বাঙ্গলা’ ও ‘বাঙালি জাতি’। আমাদের স্বাধীন বাঙ্গলার ভূখন্ডই হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের ‘বঙ্গ’ অঞ্চল। বঙ্গ কিংবা বঙ্গের সূত্র ধরে অগ্রসর হলে বাঙ্গলার সঙ্গে এর যোগসূত্র পাওয়া যায়। কুরআন মজিদে বর্ণিত পয়গাম্বর হযরত নুহু (আ) এর কনিষ্ট পুত্রের নাম ছিল হযরত ‘হাম’। হযরত নুহু (আ) এর আমলের মহাপ্লাবনের পর হাম ইরাক থেকে ভারতবর্ষে আগমন করেন। তাঁর ছয় পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম ছিল হিন্দু। হিন্দুর প্রথম পুত্রের নাম ছিল পুরুব, দ্বিতীয় পুত্রের নাম ছিল বঙ্গ। এই বঙ্গ থেকেই বাঙ্গলা এবং হাজার হাজার বছর পর মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে নামকরণ হয়েছে বাংলাদেশ। পুরুব হিন্দুস্থানের প্রথম রাজা হন। পুরুবের বংশে রাজা যুধিষ্ঠির জন্ম হয়। যুধিষ্ঠির চার হাজার বছর পর পৃথ্বিরায় জন্মগ্রহণ করেন। হিন্দু’র নামানুসারে ‘হিন্দুস্থান’ আর ভরত রায়ের নামানুসারে ‘ভারত’ এবং বঙ্গ’র নামানুসারে ‘বঙ্গ’ বা ‘বাঙ্গলা’ এবং ‘বাঙালি জাতিসত্ত্বার সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ বহুজাতিক জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে গঠিত। ইংরেজী নেশন বাক্যটি বহুল ব্যবহৃত একটি মাত্রিক বাক্য। জনগোষ্ঠী হলো, নেশন এর অন্যতম ভিত্তি। নেশন এর সমষ্টিগত ভিত্তি হলো, জনগোষ্ঠী। জনগোষ্ঠী হলো, ‘বংশ, ভাষা, ইতিহাস, ধর্ম, সংস্কৃতি’ ইত্যাদির সংমিশ্রণ। নেশন থেকে ন্যাশনালিটির উৎপত্তি। ন্যাশনালিটির অর্থ হলো, ‘জাতীয়তা’। জাতীয়তা হলো, কোনো জাতির সদস্যতা। ফরাসি বিপ্লবের পর জাতীয়তার সংজ্ঞা ব্যাপকতা লাভ করেছে। ফরাসি অভিধানে নেশন বাক্যটির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘নেশন হলো এমন মানব সমাজ যা একই ভূখন্ডে বসবাস করে, যাদের মধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিক ঐক্য’। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলেছে, ‘রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ হলো, একটি জাতিগত দলবদ্ধতার চেতনা; জাতি রাষ্ট্রভিত্তিক; ধর্ম, ভাষা কিংবা অঞ্চল ভিত্তিক নয়’। জাতীয় রাষ্ট্রের আকাঙ্খিত এবং উপার্জিত চেতনাই জাতীয় চেতনা। কৃষ্টির অনেকগুলো উপাদানের মধ্যে একটি হলো, ‘ভাষা’। শুধু একটি উপাদানের উপর ভিত্তি করে জাতীয়তাবাদী চেতনা হয় না।বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক চেতনা বলতে শুধু বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর চেতনাকে বুঝায় না। তন্মধ্যে ভারতের বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক চেতনাও পরোক্ষভাবে জড়িত। কোনো একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে যদি অন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক চেতনা বিদ্যমান থাকে, তাহলে রাজনৈতিকভাবে উভয় রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব অরক্ষিত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে যদি ভারতের বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক চেতনা বিদ্যমান থাকে, তাহলে রাজনৈতিকভাবে ভারত তাদের ওই অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব অরক্ষিত রয়েছে মর্মে উপলব্ধি করতে পারে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার রাজনৈতিক দল কিংবা কোন ব্যক্তিত্ব যদি ভারতের জন্য হুমকিস্বরূপ হয় তাহলে ভারত ওই শক্তি বা ব্যক্তিকে অবদমিত করতে যে কোন পদক্ষেপ নিতে পারে। তারা তাদের সার্বভৌমত্বের সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক কৌশলী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক চেতনার বিপরীতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী চেতনার রাজনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখতে পারে। যাতে রাজনৈতিকভাবে তাদের বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষিত থাকে।আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে বিএনপি থেকে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগের কাছে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিরাপদ নয়। দেশ রক্ষার জন্যই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে’। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে দেশের সার্বভৌমত্ব কীভাবে অরক্ষিত হয়ে পড়ে বিএনপি থেকে এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয় না। বিএনপি বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলে ভারত তাদের বাংলাভাষী অঞ্চলের রাজনৈতিক চেতনার বিষয়ে চিন্তামুক্ত থাকে। কারণ, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক চেতনার সাথে ভারতের বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাশক্তির এক হয়ে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী চেতনার রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলে ভারতের বাংলাভাষী অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষিত থাকে। ভারতের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষিত থাকলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বও সুরক্ষিত থাকবে। সুতরাং বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব অরক্ষিত হয়ে পড়ে।একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে দুই ধরনের জাতীয়তাবাদী চেতনা বিদ্যমান থাকলে জাতীয় ঐক্য ধ্বংস হয়ে যায়। জনগণ বিভক্ত হয়ে পড়ে। বিভক্ত জাতি কখনো মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পাড়ে না। বিভেদ-বৈসম্য লেগেই থাকে। এই সুযোগে প্রবল প্রতিবেশী বন্ধু না হয়ে প্রভু হয়ে যায়। তখন ওই প্রভুর সমর্থন পাওয়ার জন্য জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দিতে হয়। সীমান্তে নির্বিচারে পাখি শিকারের মতো গুলি করে হত্যাযজ্ঞ চালালে অথবা কোনো আদরের বোনকে হত্যা করে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখলে কিংবা আটক হওয়া কোনো ভাইকে উলঙ্গ করে অমানুষিক নির্যাতন করা হলেও কিছু বলা যায় না।পশ্চিমবঙ্গের জনগোষ্ঠীর সাথে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ভাষাগত আক্ষরিক মিল ছাড়া অন্যকোন মিল নেই। এই ভাষাগত মিলও খুব বেশি দিনের নয়। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই রাঢ় ও সূক্ষ্ম অঞ্চলের সঙ্গে বঙ্গ অঞ্চলের ভাষা ও কৃষ্টির পার্থক্য ছিল। অখন্ড ভারতে বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শাসনামলে তারা প্রশাসনের সুবিধার্থে রাঢ় অঞ্চলকে যুক্ত করে বাঙালি অঞ্চলের প্রশাসনিক ইউনিট গড়ে তুলেছিল। ১৮৫৪ সালে বাংলা, বিহার, উড়িষা, ছোট নাগপুর ও আসাম নিয়ে একটি প্রেসিডেন্সি করা হয়েছিল। ওই সীমারেখা এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল কৃত্রিম। ওতে কৃষ্টি বা প্রকৃতিগত কিছু ছিল না।